স্ফুটনাঙ্কঃ

Previous Previous

স্বাধীন সার্বভৌম ক্রিয়াশীল ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা না থাকলে একতা থাকেনা। আর এই আমানত ধরে রাখে যোগ্য উত্তরসূরী। দায়িত্ব বুঝে পাওয়া উম্মত দৃঢ়পদ আইন বা শরিয়ত, যা তার আদর্শ (সমার্থক অর্থে কৃষ্টি-সংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক) প্রতিষ্ঠায়। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ ও অবিসংবাদিত নেতা নবী আলাইহিমুস সালাম। প্রগতিশীলতার হত্যাকারী ধ্বংসোম্মুখ আত্মাকে রক্ষার জন্য প্রতিপালকের মনোনীত আদর্শ মানুষ বিপ্লবী মক্তির দিশারী নবী ও তার আনুসারীগন। ধারাবাহিক হযরত আদম (আ) হতে শেষ রাসুল মুহাম্মদ (দ:) অবিকৃত বার্তা(সংবাদ) আত্তীকরণ করে নিপুনতা অর্জন করেছেন প্রাচীনের প্রাজ্ঞতা, অধিকতর আধুনিক এর দর্শন, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, প্রকৌশলের যন্ত্রবিদ্যা, তাঁর নিজের ও অন্যান্য সময়ের ইতিহাস, অর্থনীতির মূল শর্তাবলী, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন চেতনা(আখিরাত) ও চিন্তাভাবনা ও তার উপলব্ধি এবং চাহিদা অনুযায়ী তার সরবরাহ সমস্ত পাঠকের(প্রত্যাশীদের) ইচ্ছা চাহিদা পূরনার্থে নীতিগতভাবে সেগুলোকে জ্ঞাত করা(পৌঁছনো)। শুধু খবর অর্জন (সংগ্রহ) কারী নয়, আমল(সুন্নাহ) করে প্রমানিত প্রতিষ্ঠা কারীও বটে। সমকালের ইতিহাসের চঞ্চল স্রোতের ভেতর বসবাস করেও, উপলব্ধি ইতিহাসের গতি-প্রকৃতি ও নির্মাণকে এবং সেখান থেকে উদ্ভব টুকরো টুকরো ঘটনার(নিদর্শন) রোগ(সমস্যা/আদেশ) চিকিৎসার(সমাধান/নিষেধ) মধ্য দিয়েই আগামীর ইতিহাসের বিনির্মাণ। দায়িত্ব পালনে অর্জিত অসাধারণ মেধা, মনন সৃজনশীল সত্তার পরিচয় লাভের যোগ্যতার। বার্তাবহ উপযোগী প্রকাশভঙ্গীর আবশ্যতায় – সমাজ সেবার অতি আধুনিক রুপ (তাবলীগ) । মানব সমাজের পুষ্টি সাধন (ঈমান আমালের মেহেনত) ও সমর্থন (ইয়াকীন অর্জন)। চক্ষু, কর্ন ও মুখ (ভয়েস) পরীক্ষা ও জয়ের কৌশল। ‘বাইফোকাল মাইন্ড’ – জ্ঞান দিকমূখীতা, কাছেও নিবদ্ধ আর দূরেও প্রসারিত। অন্তরদৃষ্ট ও কালজয়ী। ভালবাসা(ভয় – হারানোর আর পাওয়ার আকাঙ্খা) ❤️ is not only a Feelings or Emotion. Love is a decision. Imagine, one who believes in you, you love him. Trust him. Trust yourself. Love yourself. Be hatch Be Loved. Think that universal law can provide basic needs to ensure a just economic future for mankind 🌎 🗺. নিশ্চয়ই; সভ্যতা চিরন্তন ও সত্য। সভ্যতা(বিশ্বাস বিবেক জ্ঞান ভাব ভালবাসা অন্তরঙ্গ আন্তরিকতা বা মর্মিতা -আমলে সলেহ) দুর্যোগের পরও বেঁচে থাকে।

লোভে, আমরা বাঁচি? 🧡 মানসিক আত্মহত্যার অনুঘটক হল জল্পনা বা ধারণা যা বুদবুদ হয়ে ওঠে। আমরা লোভের গভীরে বাস করি। স্মার্ট !

Spring: There is no unity without the continuity of independent sovereign active tradition. And this deposit is retained by eligible successors. The ummah is responsible for establishing the strict law or shari’ah, which establishes its ideals (meaning cultural and anthropological). The greatest human being and undisputed leader of all time was the Prophet (peace be upon him). The prophet of revolutionary liberation and his followers are the ideal people chosen by the Lord to protect the destructive spirit that kills progressivism. Successive Prophet Adam (pbuh) to the last Prophet Muhammad (pbuh) mastered the wisdom of the ancients, the philosophy of the more modern, scientific knowledge, the mechanics of engineering, the history of his own and other times, the basic terms of economics, social And political life consciousness (Akhirat) and thinking and its realization and its supply according to the needs of all readers (prospects) to meet the wants and needs in principle to inform (reach) them. Not only the one who acquires (gathers) news, but also the one who proves it by deeds (Sunnah). While living in the turbulent current of contemporary history, understanding the nature and construction of history and the construction of future history through fragmented events (specimens), diseases (problems/commands), treatments (solutions/prohibitions), etc. Extraordinary talent acquired in the performance of duties, thinking merits the identity of a creative being. In the need of a suitable expression for the message – the most modern form of social service (tabligh). Nurturing (work of faith) and support (attainment of certainty) of human society. Eyes, Ears and Mouth (Voice) test and winning strategy. ‘Bifocal mind’ – knowledge is directional, focused both near and far. Insightful and timeless. Love (fear – desire to lose and gain) ❤️ is not only a Feelings or Emotion. Love is a decision. Imagine, one who believes in you, you love him. Trust him. Trust yourself. Love yourself. Be Hatch Be Loved. Think that universal law can provide basic needs to ensure a just economic future for mankind 🌎 🗺. Surely; Civilization is eternal and true. Civility (Faith Conscience Knowledge Love Love Intimate Sincerity or Mormita Amal Saleh.) Survives after disaster.

In greed, we live? 🧡 The catalyst for emotional suicide is the speculation or ideas that bubble up. We live in the depths of greed. Smart !

আধুনিকতার ক্ষত


তিন সামাজিক চুক্তি আধুনিক ইউরোপ গঠনে বুনিয়াদি ভূমিকা রেখেছে। ব্রিটিশ দার্শনিক টমাস হবস, জন লক ও ফরাসি দার্শনিক জ্যা জ্যাক রুশোর বিখ্যাত সামাজিক চুক্তিতত্ত্বগুলো পশ্চিমা জীবনচিন্তার মর্মমূলে কাজ করছে। তিনজনই একমত ছিলেন যে, প্রকৃতিরাজ্যের পরিস্থিতির কবল থেকে মুক্তির আকাক্সক্ষা থেকে নিজেদের মধ্যে চুক্তি সম্পাদনের মধ্য দিয়ে মানুষ রাষ্ট্র গঠন করেছে। তিন দার্শনিকের সামাজিক চুক্তিতত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কিসের ওপর? তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মূলত প্রকৃতি এবং তার পরিবর্তনীয় মূলভাবের বৈচিত্র্যের ওপর। এ বৈচিত্র্যের উদাহরণ হতে পারে প্রাক-আধুনিকতা থেকে আধুনিকতায় উত্তরণ। এই তিন সামাজিক চুক্তির গোড়ায় আর যেসব উপাদান রয়েছে, তার মধ্যে আছে ভয়, উদ্বেগ, বিপদ ও অজানা আশঙ্কা পরিহার করার জন্য ব্যক্তির সহজাত আচরণের অলঙ্ঘনীয় বাধ্যবাধকতার মতো বিষয়।
জ্ঞানতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক ফাটলের ধারাবাহিকতায় রেনেসাঁযুগে ইউরোপীয় জীবনে ঐতিহ্যগত ক্ষেত্রগুলোর ওপর চার্চ এবং রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব খর্ব হয়েছিল। তারপর জ্ঞানতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক বিভক্তি-ফাটল আরো গভীর হয়েছে। এর ফলে একদিকে চার্চের ‘ঐশী জ্ঞানতত্ত্ব’ আধ্যাত্মিক নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। অন্য দিকে শিক্ষার রাজনীতি ও বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে এবং রাষ্ট্রকে পরানো হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশ। এরই মধ্য দিয়ে আধুনিকতা পাদপ্রদীপের সামনে হাজির হয়। অচিরেই সে বিস্তৃত আগ্রহ এবং মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। আসমানি খোদা ত্যাগ করে মানবিকতাকে কেন্দ্র করে নতুন মূল্যবোধ ও আলোকায়নের সূচনা করে। সপ্তদশ শতকে ফরাসি দার্শনিক ডেকার্তের হাত ধরে নতুন করে বস্তুবাদী দর্শনের পথচলা শুরু হয়। মধ্যযুগে ইউরোপীয় দর্শনের মূলে ছিল বিশ্বাস। ডেকার্তে সবলে ঘোষণা করলেন, বিশ্বাস নয়, যুক্তি। যা কিছু যুক্তিগ্রাহ্য তাকেই স্বীকার করতে হবে। প্রভাবশালী দার্শনিক ছিলেন তিনি। তবে তিনিও সুসঙ্গত কোনো বস্তুবাদী দর্শন তুলে ধরতে পারেননি। তবে পরবর্তীদের জন্য তিনি খুলে দেন সদর দরজা। তার পরবর্তী দার্শনিকরা একটি প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করেন। এদের নেতৃত্বে বিজ্ঞানের রথ এগিয়ে চলে।
সামাজিক চুক্তিবিষয়ক হবস, লক ও রুশোর তিন মতবাদ মূলত দার্শনিক বাস্তবতার ফসল। একটি ছদ্ম-জ্ঞানতাত্ত্বিক ছাচ থেকে স্বজ্ঞাকে মুখ্য মনে করা এবং কর্ম-কর্তব্যবাদী বাস্তবতা এবং নৈতিক বাধ্যবাধকতার প্রস্থানবিন্দু মূলত তিনটি কল্পিত দৃশ্যকল্পে আত্মপ্রকাশ করল। প্রথম দৃশ্যকল্পে দেখা যায় হবসের তত্ত্ব, যেখানে রয়েছে ভয়াবহ প্রকৃতিরাজ্যকে এড়িয়ে যাওয়া। হবসের প্রকৃতিরাজ্যে মানুষের অবস্থা ছিল ভয়াবহ খারাপ। সারাক্ষণ থাকত দ্বন্দ্ব আর রক্তারক্তি। সেখানে চারদিকে অন্ধকার, সব কিছু কদর্য। মানুষ স্বার্থপর, আত্মতার গোলাম, ঝগড়ালিপ্ত, সবল দুর্বলকে খেয়ে ফেলে, সবাই সবাইকে অবিশ্বাস করে, কোথাও নিয়ম নেই, নেই কোনো শাসক। মানুষ এ অবস্থা থেকে বাঁচতে চাইল। নিজেদের মধ্যে চুক্তি করল। শাসক বানাল আর জন্ম নিলো রাষ্ট্র।
দ্বিতীয় দৃশ্যকল্পে দেখা যায় রুশোর তত্ত্ব। যেখানে দেখা যায় প্রাকৃতিক রাষ্ট্রের সীমিত স্বাধীনতা ও একটি জোড়াতালি দেয়া সমাজের নিপীড়নের তাপে কার্যত অকেজো হয়ে পড়া হবসের প্রকৃতি-রাজ্যের প্রতি পুরোদস্তুর চ্যালেঞ্জ। রুশোর প্রকৃতিরাজ্য সুন্দর, শান্তিপূর্ণ ছিল। মানুষ ছিল সরল-সহজ, সুখদ। পরস্পরে ছিল সহানুভূতি। তাদের আচরণ ছিল উত্তম। কোথাও হিংসা ছিল না, হিংস্রতা ছিল না। প্রতিশোধের বিষ বা ক্রোধের আগুন ছিল না। প্রকৃতির সেই রাজ্য ছিল আদর্শ, সুখময়। রুশোর কাছে এ ছিল জগতের জান্নাত। কিন্তু জান্নাতের সুখ শেষ করে দিলো জান্নাতের অধিবাসীরাই। মাছের পালের মতো তাদের বাচ্চা-কাচ্চা বাড়তে থাকল। প্রয়োজন বাড়ল। ফলে সম্পত্তির ধারণায় দেখা দিলো টানাটানি, বিশৃঙ্খলা। এর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মানুষ নিজেদের মধ্যে চুক্তি করল। যার যার ক্ষমতাকে তারা অর্পণ করল সমাজের সাধারণ ইচ্ছার কাছে। এই সাধারণ ইচ্ছা গঠন করল রাষ্ট্র।

তৃতীয় দৃশ্যকল্পে দেখা যায় জন লকের তত্ত্ব। তার প্রকৃতিরাজ্যে আছে সরলতার অপার সম্ভাবনাময় আইন কিন্তু সেখানে আছে বিদ্রোহও; নাগরিকদের চুক্তিগত অধিকার সংরক্ষণে ব্যর্থতার শর্তে বিদ্রোহ। তার প্রকৃতিরাজ্যেও ছিল সাম্য, স্বাধীনতা, শান্তি। মানুষ ছিল সুখে। কিন্তু বিদ্যমান ছিল কিছু সমস্যা। এসব সমস্যা দূর করার জন্যই স্বেচ্ছায় ও সর্বসম্মতিতে মানুষ চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। তারা চুক্তি করে অবাধ ও ক্ষতিকর স্বাধীনতা ছাড়া সব ধরনের স্বাধীনতা ভোগ করার জন্য। কিন্তু তাদের স্বাধীনতা হরণ করার ঘটনাও ঘটে। সে জন্য শাস্তির প্রয়োজন। তবে প্রত্যেকেই অন্যকে শাস্তি দেয়ার অধিকার চর্চা করলে যেহেতু সমস্যা, তাই শাস্তি প্রয়োগের অধিকার তারা অন্যের কাছে তুলে দেয়। বানায় কর্তৃপক্ষ, নেতৃত্ব। গঠন করে রাষ্ট্র।
এই যে সামাজিক পরিবর্তন, সঙ্কট উত্তরণ ও নিজেদের কল্যাণকে বেছে নেয়ার ও উদযাপন করার তত্ত্ব, এখানে ঈশ্বর নেই। মানুষই সমস্যায় পড়েছে, মানুষই নিজেকে উদ্ধার করছে। কারো পথনির্দেশ লাগছে না, আসলে এর দরকার নেই বলেই তো লাগছে না! অতএব ইউরোপীয় বুদ্ধিবৃত্তি ঈশ্বরভিত্তিক দুনিয়াদৃষ্টি থেকে গণভিত্তিক দুনিয়াদৃষ্টির উপর আশ্বস্ত হলো। মানুষ ও সম্মিলিত মানুষই সঙ্কটের সমাধান। জীবনের প্রগতি ও কল্যাণের নির্মাতা।
এলেন ফ্রেডরিখ নিটশে। তিনি দেখাতে চাইলেন প্রকৃতি ও প্রাণিজগতে টিকে থাকার বিরতিহীন লড়াই। এ লড়াই থেকে জন্ম নেয় প্রতিপত্তির নেশা। ফলে কেউ শোষক হবে, স্বৈরাচারী হবে, এটি স্বাভাবিক। যেমন স্বাভাবিক কারো শোষিত হওয়া বা দাস হওয়া। টিকে থাকার লড়াইয়ে আপনি যখন হেরে গেলেন, দাসত্ব আপনার অবধারিত।
এই সংগ্রামে ধর্মবিশ্বাসের কী কাজ? নিটশের কাছে ধর্মবিশ্বাস মস্ত এক মিথ্যা। তবে সমাজের স্বাভাবিক কর্মপরিক্রমায় তার কিছু উপকারও রয়েছে। ধর্মকে বাদ দিতে হলে নির্দেশনা, আশাবাদ, নিশ্চয়তা, নৈতিকতা, সান্ত্বনা ও আধ্যাত্মিক লক্ষ্য পূরণে সহায়তার জন্য অন্য উপায় খুঁজে বের করতে হবে। ধর্মের খালি জায়গা পূরণ করতে পারে সংস্কৃতি। দর্শন, শিল্পকলা, সঙ্গীত ও সাহিত্য দিয়ে কাজটি চলতে পারে। ধর্মগ্রন্থের জায়গা দখল করবে সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্য। কিন্তু নিটশে কি জানতেন না, ধর্মবিশ্বাসের জায়গায় যখন আধুনিক দর্শনজাত বিশ্বাস প্রতিস্থাপিত হয় এবং ধর্মাচারের জায়গা যখন দখল করে আধুনিক সংস্কৃতি, তখন আধুনিকতাও হয়ে উঠে এক ধর্ম? ধর্ম থেকে পলায়ন করতে গিয়ে তিনি অন্য ধর্মের খাঁচায়ই তো ঢুকলেন। এই ধর্মের অনুসারীদের বিশ্বাস ও প্রবণতা একই।

এই যে বাঙালি বুদ্ধিজীবী মোতাহার হোসেন চৌধুরী লিখেছেন, ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার আর কালচার শিক্ষিত মার্জিত লোকের ধর্ম। কালচার মানে উন্নততর জীবন সম্বন্ধে চেতনা-সৌন্দর্য, আনন্দ ও প্রেম সম্বন্ধে অবহিত। সাধারণ লোকেরা ধর্মের মারফতেই তা পেয়ে থাকে…, নিটশে সেই কথাটিই বলেছিলেন শতাব্দীপূর্বে। বাঙালি বুদ্ধিজীবী পুরনো সেই পুনরোক্তিকে নতুনের আনন্দে উচ্চারণ করলেন। তাকে দশকের পর দশক আউড়ানো হচ্ছে সত্য বিশ্বাসে, আধুনিকতা ভিন্ন অর্থে ধর্মের রূপ না নিলে এমন হতো? তিনি কালচারকে দিয়েছেন খোদার জায়গা। এ বিশ্বাস তার ধর্মবিশ্বাসের মতোই। যার সাথে যুক্ত আছে যুক্তির নামে এক সেট স্টেরিওটাইপ! কালচার আধুনিকতাবাদের খোদা হতে চেয়েছে ধর্মের খোদাকে হত্যার ঘোষণা দিয়ে। নিটশে উন্মাদ বৃদ্ধের জবানিতে ঘোষণা করেন খোদা মরে গেছে, সে মৃত।
এই ঘোষণা অভূতপূর্ব, যা ভূমিধসের মতো অবিশ্বাস্য সমস্যা তৈরি করে। খোদা তো স্বয়ম্ভূ। তিনি প্রাণ সঞ্চার করেন। তার নির্দেশে ও বচনে জগত সৃষ্টি হয়েছে। অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে আমাদের বিরাজমানতা তারই অনুদান। জন্ম ও মৃত্যু তারই সৃষ্টি। তার সৃষ্টি তাকে করতলগত করতে পারে না। জন্ম পারে না তাকে জন্ম দিতে। মৃত্যু পারে না তাকে মেরে ফেলতে। তা হলে যিনি খোদা, তিনি আবার মরতে পারেন কিভাবে? যিনি মরে যান, তিনি খোদা হতে পারেন না। নিটশে এমন কোনো মরণশীল খোদার অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন যে খোদা হঠাৎ করে ঊনবিংশ শতকে মারা গেছেন। কারণ নিটশে নিজেরে অভিহিত করেছেন একজন প্রবৃত্তিগত বা স্বভাবজাত নাস্তিক হিসেবে। নিটশে মূলত খোদার মৃত্যুর ঘোষণার মধ্য দিয়ে তার নাস্তিকতাকে উদযাপন করতে চেয়েছেন এবং খ্রিষ্টধর্মের কল্পিত পরিণতির কথা রাষ্ট্র করতে চেয়েছিলেন। তার এ মতামত আধুনিক মন ও দৃষ্টির খুব নিকটাত্মীয় ছিল। যার কাছে খোদা কখনোই ছিল না। কিংবা আগে ছিল, এখন মরে গেছে। অথবা খোদা থাকলে আছে, না থাকলে নেই! তার কাছে আধুনিকতাবাদ হলো অতিপ্রাকৃত খোদা ও পরকাল বিশ্বাসের একটি উপাদেয় বিকল্প।

আধুনিকতা এভাবেই নতুন ধর্ম, নতুন বিশ্বাস ও নতুন খোদা হয়ে হাজির হলো। তার উদ্ভবে অবসিত হলো প্রাচীন যুগ। তার চরিত্রে ছিল ঐতিহ্যের বিরোধিতা। ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী জ্যঁ বদ্রিয়াঁ (১৯২৯-২০০৭) ঠিকই ধরেছেন, আধুনিকতার খাসলত হলো যা কিছু ঐতিহ্য ও প্রাচীন সংস্কৃতি, তার সাথে দুশমনি করা। মডার্ন কথাটি বর্তমানকে প্রতিনিধিত্ব করতে চায়। পঞ্চদশ শতকের শেষ দিকে এর ব্যবহার ঘটেছিল বর্তমানকে ব্যক্ত করার জন্যই। পরে তা যুগের এমন সচেতনতাকে ব্যক্ত করতে থাকে, যা পুরনো থেকে নতুনে বিবর্তনের ফসল হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে চায়।
পুরাতনকে এবং মানব- ঐতিহ্যকে বাদ দেয়ার ফলাফল কি ইতিবাচক হয়েছে? মোটেও তা হয়নি; বরং এর ফলে ব্যক্তি ও বস্তুচিন্তা মানুষের চালক হয়েছে, মুনাফালোভ মানবমনের কর্তৃত্ব গ্রহণ করেছে, ভোগলিপ্সা আপন হাতে তুলে নিয়েছে জীবনের লাগাম। কিন্তু এ ব্যাপারগুলো ঘটেছে মানবতাবাদ, ব্যক্তিস্বাধীনতাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার মোড়কে। মানুষ যা হারিয়েছে, তা হলো সত্যবোধ, সত্যলগ্নতা। হারিয়েছে প্রশান্তি ও নির্ভরতা। হারিয়েছে আত্মজয় ও আধ্যাত্মিকতা। সব কিছু সে জয় করতে চেয়েছে শুধু নিজেকে ছাড়া। যখনই নিজেকে জয় করতে চেয়েছে, তখনই নিজেকে নিজে খুঁজে পায়নি কোথাও। কারণ সে ঠিকানাহীন চোরাবালিতে হারিয়ে গিয়েছিল। মানবীয় পবিত্রতার বোধকে সে চিনতে পারেনি। সে একে কামনা করতেও ভুলে যায়। সে চলেছে বিপরীত পথে। যার ফলে সামাজিক ধ্বংসের ইতিকথা হয়ে উঠেছে তার পথের পৃষ্ঠাসমূহ।
নিজের ভেতরে সে নিজেকে ধ্বংস করেছে প্রতিনিয়ত। ফলে বাইরের ধ্বংসকর্মও ছিল তার নিয়তির অংশ। সে হিউম্যানিটির কথা বলেছে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু তার হাতে হিউম্যানিটি হয়েছে সবচেয়ে বেশি ধ্বংসের শিকার। পয়লা ও দুসরা মাগরেবি মহাযুদ্ধ সেই বিনাশের পয়লা ও শেষ স্মারক নয়, কারণ আরো আগে আধুনিকতার রফতানিকারী পশ্চিমারা ঔপনিবেশিক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে দুনিয়াজুড়ে। যা মানুষের জন্য বিপদ হিসেবে দুই মহাযুদ্ধের চেয়ে ছোট ছিল না। পয়লা মহাযুদ্ধ (২৮ জুন, ১৯১৪-১১ নভেম্বর ১৯১৮) কমপক্ষে ৯০ লাখ সৈন্য ও ৫০ লাখ সাধারণ মানুষের মৃত্যু এবং তিন কোটি মানুষের আহত, পঙ্গু ও জখমি হওয়ার মধ্য দিয়ে থামলেও তার গর্ভে নিহিত ছিল দুসরা মহাযুদ্ধের বারুদ। ১৯৩৯ সালে শুরু হওয়া এ যুদ্ধ ইউরোপে ১৯৪৫ সালে শেষ হয় বটে; কিন্তু এশিয়ায় পরবর্তী সংঘর্ষগুলোকে হিসাবে ধরলে এ যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে ১৯৩৯ সালে। ৩০টি দেশের ১০ কোটিরও বেশি সামরিক সদস্য অংশ নেয় এ যুদ্ধে। কেবল ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫-এর মধ্যে মারা যায় আট কোটি মানুষ। এ দুই মহাযুদ্ধ ছাড়াও ঘটিয়েছে মানবসংহারি বহু যুদ্ধ। কোনো মহান কল্যাণকে আমন্ত্রণ করা এবং কোনো শান্তিকে নিশ্চিত করার কাজ করেনি যুদ্ধগুলো। এগুলো মূলত শুরু হয়েছিল জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের অহমিকা, পররাজ্য ও পরস্বত্বগ্রাস ও নিকৃষ্ট বর্ণবাদ থেকে।
আধুনিকতার শক্তি অনুসন্ধান করেছে শিল্প ও পুঁজিবাদে। কিন্তু অবাধ পুঁজিবাদই তাকে শেষ অবধি পতনের প্রান্তে টেনে নিচ্ছে। পুঁজিবাদ তার শক্তি এবং পুঁজিবাদ তার দুর্বলতা। এই শক্তি প্রান্তিক, কিন্তু এই দুর্বলতা সর্বগ্রাসী। আধুনিক বিজ্ঞানের বিপুল ও বহুব্যাপ্ত মদদ, জ্ঞান ও উদ্ভাবনের গ্রহ অতিক্রমী জোয়ার, তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ময়কর বিপ্লবও আধুনিক সভ্যতার গভীর এবং অমোচনীয় ক্ষতস্থানগুলোকে ঢাকতে পারছে না।

সঙ্ঘাতের গোড়া


ইংরেজি Atheist শব্দটি ফরাসি শব্দ থেকে উৎপত্তি। শব্দটি ঈশ্বরবিহীন অর্থে ব্যবহৃত হয় সর্বপ্রথম ১৫৭৭ সালে। শুরুর দিকে শব্দটি একটি অপমানজনক শব্দ হিসেবে পরিচিত ছিল। তাই যে কেউই নিজেকে নাস্তিক হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করত। সমাজে এখনো অনেকে বিশ্বাসগতভাবে স্রষ্টা ও ধর্মে অবিশ্বাসী। কিন্তু ধর্মীয় প্রভাবের কারণে তারা নিজেদেরকে নাস্তিক বলতে সাহস করে না। নিজেকে নাস্তিক হিসাবে পরিচয় দেয়ার সূত্রপাত হয় সর্বপ্রথম অষ্টাদশ শতকে ইউরোপে। আধুনিক যুগে বিশ^ময় সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার প্রধান দর্শন হলো গণতন্ত্র। আর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, নাস্তিক্যবাদ, সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদ একে অপরের সহায়ক ও পরিপূরক শক্তি। এ মতবাদগুলো বর্তমানে গোটা বিশ্বকে দাপটের সাথে শাসন করে চলেছে। তথাপিও সমাজজীবন থেকে ধর্মীয় প্রভাব দূর করা যায়নি। গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও পুঁজিবাদী অনেক রাজনৈতিক নেতা আছেন যারা ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে ধর্মের নির্দেশ মান্য করে থাকেন। এ কথা সত্য যে, আধুনিক মতবাদগুলো মানুষের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছে। তবে এটাও সত্য যে, পরিবার, সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনে প্রচলিত মতবাদগুলোর চেয়ে ধর্মীয় চেতনার প্রভাবই বেশি লক্ষণীয়। এ প্রভাব মানুষকে আত্মীক ও সামাজিকভাবে উন্নীত ও উজ্জীবিত করেছে। এ বিশ^াস বিশ^াসীদের জীবনাচারও মানবসত্তাকে উন্নত ও পরিশীলিত করেছে। ধর্মীয় অনুশীলন মানবজাতিকে উদারতা, রুচিশীলতা, ভদ্রতা ও উন্নত সুশাসন উপহার দিয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ধর্মের বিধান মতে দাউদ (আ:) ও সুলাইমান (আ:) বিশাল এ পৃথিবী পরিচালনা করেছিলেন। অন্যান্য ধর্ম প্রবর্তকগণও তাদের ব্যক্তি জীবনকে ধর্মের বাণীর কাছে দ্বিধাহীনচিত্তে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। ধর্মের নির্দেশ মোতাবেক তারা তাদের পরিবার ও সমাজ জীবন সাজিয়েছিলেন। তাদের ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনের প্রভাব রাজনৈতিক জীবনকেও ব্যাপকভাবে আন্দোলিত করেছিল। ফলে রাষ্ট্রে বসবাসরত নাগরিকদের মন-মানস ধর্মের প্রভাব থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারেনি। ধর্মের এ ব্যাপক অনুশীলন করতে গিয়ে ধর্মগুরুরা জাগতিক সব সুযোগ সুবিধা বিসর্জন দিয়েছিলেন। তারা জীবনের সব মায়া ত্যাগ করেছেন। সুখ-শান্তি ও ঐশ্বর্য জলাঞ্জলি দিয়ে পৃথিবীতে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ধর্মহীন পুঁজিবাদী স্বার্থান্বেষী শাসকগোষ্ঠী সবসময় তাদেরকে কোণঠাসা করে রেখেছে। মিথ্যা ও ঠুনকো অজুহাতে ক্ষমতাসীনরা তাদেরকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছে। শেষ পর্যন্ত তাদেরকে বাড়ি ত্যাগ, দেশ ত্যাগ এমনকি প্রাণটাও ত্যাগ করতে হয়েছে। এতদসত্ত্বেও তারা তাদের ধর্ম প্রচার এবং মানবসমাজে তা প্রতিষ্ঠার অনন্ত সাধনা থেকে এতটুকুও পিছপা হননি। মহানবী সা:-এর আগমনের মাধ্যমে ধর্ম প্রবর্তকদের আগমনের এ ধারার সমাপ্তি ঘটেছে। ৬১০ সালে নবুয়তপ্রাপ্ত হয়ে তিনি মাত্র ২৩ বছর বেঁচে ছিলেন। এ অল্প সময়ের ব্যবধানে তাঁর প্রচারিত ধর্মের শাশ^ত আবেদন আরববাসীর কঠোর হৃদয়কে জয় করতে সক্ষম হয়েছিল। পরবর্তীতে তিনি গোটা আরব রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। পৃথিবীর সব ইতিহাস এ সাক্ষ্য দেয় যে, রাসূল হিসেবেই তিনি রাষ্ট্রপতির পদটি অলঙ্কৃত করেন। নির্বাচিত হয়ে তিনি আরবে বসবাসরত সব জাতি ও ধর্মের নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন। অথচ তাঁর এ রাষ্ট্রের সংবিধান ছিল আল কুরআন। আল-হাদিস ছিল রাষ্ট্র পরিচালনার গঠনতন্ত্র। আর মসজিদে নববী ছিল সংসদ সচিবালয়। তাঁর মৃত্যুর পর খোলাফায়ে রাশেদীন সুদীর্ঘ ৩০ বছর তাঁরই অনুসৃত ফর্মুলায় রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। তাঁরা সবাই অতি নির্ভুলভাবে ধর্মতাত্ত্বিক রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন এই কুরআন ও হাদিস দিয়েই। তৎপরবর্তী উমাইয়া ও আব্বাসীয় যুগে রাষ্ট্র পরিচালনার ধারা একই নিয়মে পরিচালিত ছিল।
এ কথা মিথ্যা নয় যে, খোলাফায়ে রাশেদীন এবং পরবর্তী সব মুসলিম শাসনামলে নিজেদের মধ্যে অনেক ফিতনা-ফাসাদ, হাঙ্গামা ও যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এক মুসলিমের হাতে অন্য মুসলিমের শাহাদাতের মতো ঘটনাও ঘটেছিল অনেক। কিন্তু সেখানে ধর্মের কোনো দোষ ছিল না। দোষ ছিল না আল্লাহর নাজিলকৃত ইসলামে। এটা স্বাভাবিক যে, প্রবৃত্তিতাড়িত হয়ে যেকোনো মুসলিম নেতাই ভুল করে থাকতে পারেন। সিদ্ধান্ত নিতে গিয়েও ভুল হতে পারে। তেমনটিই ঘটেছিল বিভিন্ন মুসলিম শাসনামলে। তাই ধর্ম আর ধার্মিককে এক করে দেখা ঠিক নয়।
তবে এটাও সত্য যে, বর্তমানের গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদগুলোতে রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে যুদ্ধ ও রক্তপাত কম ঘটেনি। ১৯১৪ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ৪০ কোটি মানুষের হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল। এ যুদ্ধের সাথে ধর্মের কোনোই সংস্রব ছিল না। এ যুদ্ধে নিহত মানুষের সংখ্যা ছিল এক কোটির উপরে। ১৯৩৯ সালে সংঘটিত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এ যুদ্ধে নিহত মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ৮ কোটি। এ ছাড়া গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে ২০০৩ সালে আমেরিকা কর্তৃক ইরাক আক্রমণ বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষভাবে অবলোকন করেছে। ২০০৩ সালে শুরু হওয়া আক্রমণটি শেষ হলেও তার রেশ এখনো শেষ হয়নি। এ আক্রমণে নিহত হয়েছে এক কোটি ২০ লাখ নির্দোষ, নিরীহ মানুষ। আর এ আলোচনার বাইরের যুদ্ধগুলোতো আছেই।

মূলত আদম (আ:) থেকে শুরু হওয়া ধর্মের মৌলিকত্ব ঠিক রেখে সময় এবং যুগের চাহিদা মতো বিভিন্ন সময়ে আল্লাহ তায়ালা নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছেন। পাঠিয়েছেন সময়োপযোগী কিতাব ও বিধিবিধান। আর মুহাম্মদ সা: সেই ধারাবাহিকতার সর্বশেষ প্রবর্তক। তাঁর আগমনের মাধ্যমে ধর্ম আগমনের ধারার সমাপ্তি ঘটেছে। ৬৩২ সালে মহানবী সা:-এর মৃত্যুর পর পৃথিবীতে আর কোনো নবী আসেননি এবং আসবেনও না। এ ধর্মই সর্বকালীন, সার্বজনীন এবং সামগ্রিক আধুনিকতার পরিপূরক একটি পূর্ণাঙ্গ আদর্শ। তার অন্তর্ধানের আজ ১৩৯১ বছর পরেও মধ্যপ্রাচ্যসহ এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে। তাদের পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিকপরিমণ্ডল ধর্মের বিধানেই পরিচালিত। এসব দেশ প্রচলিত গণতন্ত্রী, সমাজতন্ত্রী ও অন্যদের মতো বিশ্বদরবারে যুদ্ধবাজ ও দাঙ্গাবাজ হিসেবে পরিচিত নয়। প্রতাপশালী গণতন্ত্রী নেতাদের মতো তাদের কেউই সন্ত্রাসী, আগ্রাসী ও দখলবাজ মনে করে না।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, পৃথিবীর মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ২.৩% মানুষ আছে যারা ধর্মকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেন। তারা ধর্মহীন বিভিন্ন মতাদর্শে প্রভাবিত। তারা তাদের জীবনের সামগ্রিক বিষয় ঐ মতাদর্শ দ্বারাই পরিচালনা করতে চান এবং করেন। মজার ব্যাপার হলো, তারা ধর্মে অবিশ^াসী হলেও তাদের কর্মকাণ্ড সততা, নিষ্ঠা, নৈতিকতা ইত্যাদি নীতিকথায় ভরপুর। অথচ এ কথাগুলো ধর্মীয় বিভিন্ন গ্রন্থ থেকেই উৎসারিত।
ধর্ম থেকে রাষ্ট্রকে বিচ্ছিন্ন করার প্রবণতাটা সৃষ্টি হয়েছে মুক্তমনা দর্শন চর্চার মানসিকতা থেকে, কিছু অবিশ^াসীর মাধ্যমে। অথচ দর্শনের ইতিহাস চর্চা করলে দেখা যাবে যে, দর্শনের সাথে ধর্মের কোনো বিরোধ কখনোই ছিল না। ষষ্ঠ শতাব্দীতে ব্যাপকভাবে দর্শনের চর্চা শুরু হয়। আর দর্শন চর্চার প্রাণপুরুষ ছিলেন সক্রেটিস, প্লেটো এবং এরিস্টটল। তারা সবাই একেশ্বরবাদী ছিলেন। তারা কখনো ধর্মের বিরুদ্ধে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতেন না, নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টিও করতেন না। তারা কখনো ধর্মের নেতিবাচক ব্যাখ্যা প্রদান করেননি। তাদের জীবনী পাঠ করলে দেখা যায়, সামগ্রিক জীবনে তারা ধর্ম পালনের যৌক্তিকতা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। সক্রেটিসের ছাত্র প্লেটো, প্লেটোর ছাত্র এরিস্টটল আর এরিস্টটলের ছাত্র ছিলেন আলেকজান্ডার। দিগি¦জয়ী মহাবীর আলেকজান্ডার বহু ঈশ্বরবাদে বিশ্বাসী হলেও ধর্মের প্রতি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। তার সময়ে রাষ্ট্র চলেছে স্বাধীনভাবে আর ধর্মও চলেছিল তার নিজস্ব গতিতে। এটা নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা ছিল না। ধর্ম ও রাষ্ট্রের বিরোধ নিয়ে যত তর্কবিতর্ক, সেটা আধুনিক নাস্তিক্যবাদী ধ্যান-ধারণারই ফল।

দর্শন চর্চার নিমিত্তে ষষ্ঠ শতাব্দীতে গ্রিকরা অসংখ্য স্কুল তৈরি করেছিল। সেসব স্কুলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দর্শনের অনুশীলন হতো। সেখানে ধর্ম কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি এবং ধর্ম সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণাও ওই প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে তখন তৈরি হয়নি। তখন এক দিকে চার্চকে কেন্দ্র করে পরিবার ও সমাজ জীবনে ধর্মের ব্যাপক অনুশীলন হতো। অন্য দিকে, স্কুলগুলোতে মুক্তমনের দর্শন চর্চার কাজ ভালোভাবেই চলত। কিন্তু এই উন্মুক্ত দর্শন চর্চায় এবং মুক্ত মনের মতপ্রকাশে বাদসাধল তৎকালীন বাইজান্টাইন (রোমান) সম্রাট জাস্টিনিয়ান। জাস্টিনিয়ান ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। নিজের ক্ষমতাকে দীর্ঘ ও পোক্ত করতে ফন্দিফিকির করতে থাকেন। ৫২৯ সালের ঘটনা। জাস্টিনিয়ান সব গ্রিক স্কুল ভেঙে দেন!
জাস্টিনিয়ানের উদ্দেশ্য ছিল সবাইকে মূর্খ বানিয়ে ক্ষমতা প্রলম্বিত করা। জাস্টিনিয়ান প্রজাদের ওপর শাসনের নামে শোষণের স্টিম রোলার চালাতে লাগল। দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে চলল জাস্টিনিয়ানের এ জঘন্য শাসন। এতে মানুষের মুক্ত মনের ভাবনার পথ রুদ্ধ ও শৃঙ্খলিত হয়ে গেল। শোষিত জনগণ জাস্টিনিয়ানের জুলুম এবং শোষণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। মনের গভীরে তারা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠল। কিন্তু তাদের কিছুই করার ছিল না। এ সময়ে চার্চও আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। এভাবে চার্চ তথা ধর্মের সাথে রাষ্ট্র তথা শাসকগোষ্ঠীর সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে।
ধূর্ত জাস্টিনিয়ান গদি রক্ষার্থে ধার্মিক সাজার ভান করে। সে চার্চের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে। ক্ষুব্ধ জনতার ক্ষোভ প্রশমন করতেই জাস্টিনিয়ান চার্চের দ্বারস্থ হয়। সে নতুনভাবে ধান্ধাবাজিতে লিপ্ত হয়। এ ধান্ধাবাজিতে ধূর্ত জাস্টিনিয়ান সফলতা লাভ করে। জাস্টিনিয়ান ধর্মের লেবাস ও মুখোশ পরিধান করে। সে তার ধূর্ততা আর ক্ষমতাকে দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে ধর্মীয় নেতাদের বশ করে। এরই এক পর্যায়ে ধর্মগুরুদের শাসকগণ দরবারি ধর্মযাজকে পরিণত করে। ধর্মযাজকরা রাষ্ট্রের অনুচর ও সেবাদাসে পরিণত হয়। অত্যাচারী শাসক আর দরবারি ধর্মযাজক একে অপরের সহায়ক শক্তিতে পরিণত হয়। ধর্মযাজকদের সহায়তায় জাস্টিনিয়ান নতুনভাবে শক্তি ও ক্ষমতা সঞ্চয় করে।
ক্ষমতার জোরে শাসকরা ইচ্ছামতো ধর্মীয় নেতাদের ব্যবহার করতে শুরু করে। রাষ্ট্রনেতা এবং ধর্মনেতা এ দুইয়ের যোগসাজশে শুরু হয় ইচ্ছামতো রীতি এবং বিধান তৈরির ফর্মুলা। ক্ষমতাধর জাস্টিনিয়ান জোর প্রতাপের সাথে উত্তর আফ্রিকা, সিসিলি এবং ইতালির একটি অংশের শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তার রাজত্বকাল ছিল ৫২৭ সাল থেকে ৫৬৫ সাল পর্যন্ত। জাস্টিনিয়ানের ধারাবাহিকতায় চলতে থাকা এই রাজত্বে ধর্মযাজকরা পরিপূর্ণ ধর্মব্যবসায়ীতে পরিণত হয়। চতুরতার সাথে তাদের রচিত আইনের অনৈতিক ব্যবহার জনগণের ওপর চাপাতে থাকে। স্বৈরতান্ত্রিক সরকার আর ধর্মযাজকদের ধর্মব্যবসা একই ধারায় প্রবাহিত হতে থাকে। কিন্তু জনগণ মন থেকে সেটা মেনে নিতে পারেনি। তারা ঘৃণাভরে সেটি প্রত্যাখ্যান করে।


প্রাচীন যুগ থেকে আধুনিক কাল অবধি প্রাজ্ঞ মনীষীরা শিক্ষাকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়াস পেয়েছেন। Puritan যুগের শ্রেষ্ঠ ইংরেজ কবি মিল্টনের মতে- দেহ, মন আত্মার সুসামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নয়নই হচ্ছে শিক্ষা। ব্যাপকতর অর্থে শিক্ষা বলতে এমন এক প্রক্রিয়াকে বোঝায় যার মাধ্যমে ব্যক্তি জ্ঞান বা অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করতে পারে অথবা অনুভূতি বা দক্ষতার উন্নয়ন সাধনে সক্ষম হয় (Encyclopedia Americana, vol.ix, USA, 1983 CE, p.642). অনেক লেখকের মতে, শিক্ষা এমন এক শক্তির নাম যা মানবীয় উন্নয়নকে প্রভাবিত করে। Compton’s Encyclopediaতে শিক্ষার সংজ্ঞা নিরূপণ করতে গিয়ে বলা হয়েছে, Education is the process through which man endeavors to pass along to his children his hard-won wisdom and his aspiration for a better world. অর্থাৎ ‘শিক্ষা হচ্ছে এমন প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে মানুষ তার কষ্টার্জিত প্রজ্ঞা ও আশা-আকাক্সক্ষাকে তার সন্তানদের কাছে হস্তান্তরের প্রয়াস চালায় উন্নততর বিশ্ব গঠনের জন্য (Compton’s Encyclopedia, Chapter Education, vol.vii, University of Chicago, USA, 1986 CW, p.74).
যেকোনো জাতির আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক উৎকর্ষ সাধনের মূল মাধ্যম হচ্ছে শিক্ষা। যেকোনো জাতির বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর লালিত আকিদা বিশ্বাস ও জীবনবোধের বাস্তব দর্পণ হচ্ছে শিক্ষা। যুগে যুগে মানবগোষ্ঠীর কাছে নবী ও রাসূল প্রেরণের তাৎপর্য বর্ণনা করে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেটিই শিক্ষার ব্যাপকতার সংজ্ঞা। যেমন- ‘আমি পাঠিয়েছি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের জন্য একজন রাসূল, যিনি তোমাদের কাছে আমার বাণীসমূহ পাঠ করবেন এবং তোমাদের পবিত্র করবেন, আর তোমাদের শিক্ষা দেবেন কিতাব ও তার তত্ত্বজ্ঞান এবং শিক্ষা দেবেন এমন বিষয় যা কখনো তোমরা জানতে না।’ (আল-কুরআন, সূরা বাকারা-১৫১) সুতরাং পবিত্র কুরআনের ভাষায় অজানাকে জানার নাম শিক্ষা। মহাকবি আল্লামা ইকবালের মতে, ‘শিক্ষার দর্শন হচ্ছে খুদী যার অন্তর্নিহিত অর্থ ব্যক্তিত্বের ঔৎকর্ষ সাধন, আত্মিক শক্তির উজ্জীবন ও আত্মার উন্নতি বিধান।’ এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটি ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার মধ্যে ঐক্য ও অখণ্ডতাবোধ সৃষ্টি করে, মহান স্রষ্টার দিকে আকৃষ্ট করে, ব্যক্তিকে পশুত্বের স্তর থেকে মনুষ্যের স্তরে উন্নীত করে, অহংসর্বস্ব ভাবপ্রবণতা বিদূরিত করে, আল্লাহর বিধানের প্রতি আনুগত্যের জন্ম দেয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই জীবনের একমাত্র লক্ষ্যরূপে পরিণত করে (ইসলামী বিশ্বকোষ, তৃতীয় খণ্ড, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, পৃষ্ঠা : ৩০৫-৩১৬)।

শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বহুবিধ ও সুদূরপ্রসারী। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও সুখসমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও মানবীয় গুণাবলির বিকাশ সাধনপূর্বক দায়িত্বশীল জনগোষ্ঠী তৈরি করাই শিক্ষার অন্যতম মূল উদ্দেশ্য। একটি দেশের জনগোষ্ঠীর ব্যক্তি ও সামষ্টিক চাহিদা পূরণ এবং তাদের আশা আকাক্সক্ষার বাস্তবায়নই হচ্ছে শিক্ষার লক্ষ্য। এককথায় শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে মহান আল্লাহ পাকের সাথে বান্দার সম্পর্ক নিরূপণ, হকের বিকাশ ও সত্যের অšে¦ষা, আদর্শিক মূল্যবোধের বিকাশ, স্বকীয় সংস্কৃতির সংরক্ষণ এবং মহৎ জীবন সাধনায় ও সচ্চরিত্র গঠনে সঞ্জীবিত শক্তির সঞ্চার। শিক্ষার ব্যবহারিক উপযোগিতা ব্যক্তি ও সামাজিক উভয় পর্যায়ে সমানভাবে কার্যকর। শিক্ষার সামাজিক কাজ হচ্ছে প্রতিটি ব্যক্তিকে সহায়তা প্রদান করা যাতে করে সে সমাজের কার্যকর সদস্য হিসেবে দাঁড়াতে পারে এবং বর্তমান ও অতীতের সম্মিলিত অভিজ্ঞতা যেন তার কাছে স্থানান্তরিত হয়। শিক্ষার Individual function হচ্ছে সফলতার সাথে নতুন অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে নিজের মধ্যে সৃষ্টিধর্মী জীবনের সঞ্চার করা এবং সুপ্ত মেধার স্ফুরণের মাধ্যমে নিজকে অধিকতর যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলা (Encyclopedia Americana, vol.ix, USA, 1983 CE, p.642). জন স্টুয়ার্ট মিল শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে বলেন- Education includes whatever we do for ourselves and whatever is done for us by others for the express purpose of bringing us nearer to the perfection of our nature. অর্থাৎ ‘আমাদের প্রকৃতির পূর্ণতা সাধনের পথে নিয়ে যাওয়ার সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে নিজেদের জন্য আমরা যা করি এবং অন্যরা আমাদের জন্য যা করে তাই শিক্ষা (Encyclopedia of Religion and Ethics edited by James Hastings, Chapter `Education’, vol.v, Edinbargh, 1981, p.166)’ ব্যাপকতর অর্থে মানবীয় অনুষদ ও চরিত্রের উপর প্রত্যক্ষ প্রভাব সৃষ্টিই শিক্ষার উদ্দেশ্য।
শিক্ষার উপর্যুক্ত সংজ্ঞা ও লক্ষ্য উদ্দেশ্য পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়- দেহ, মন ও আত্মার সুসমন্বিত ঔৎকর্ষের জন্য নৈতিক ও আদর্শিক মূল্যবোধ অপরিহার্য পূর্বশর্ত। শিক্ষার উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে Encyclopedia Britannica যে মন্তব্য করেছে তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য : Education can be viewed as the transmission of the values and accumulated knowledge of a society. ‘একটি সমাজের পুঞ্জীভূত জ্ঞান ও মূল্যবোধের হস্তান্তর হচ্ছে শিক্ষার উদ্দেশ্য (Encyclopedia Britannica, Chapter Ô History of Education’, vol.xviii, Macropedia, 15th ed. 1986 CE, USA, p.11).
ঐশী চেতনায় লালিত আদর্শ ও মূল্যবোধ ছাড়া কেবল ইহজাগতিক ও বস্তুতান্ত্রিক উদ্দেশ্য নিয়ে রচিত শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে কোনো আদর্শ ও সৎ নাগরিক তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। পাশ্চাত্যে প্রচলিত আদর্শিক মূল্যবোধ বিবর্জিত শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিকতার স্খলন রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতো। ইউরোপে কুমারী মাতার প্রচলন, পারিবারিক প্রথার বিনাশ, লিভ টুগেদার সংস্কৃতি, সমকামিতার আইনগত সিদ্ধতা প্রভৃতি নৈতিকতা গর্হিত কার্যাবলি বস্তুতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থারই সাক্ষাৎ কুফল।

শিক্ষা জাতির নিয়ামক শক্তি। জ্ঞান বিজ্ঞান মানবজাতির এক অফুরন্ত সম্পদ। শিক্ষা মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে এবং মিথ্যা থেকে সত্যের দিকে পরিচালিত করে। যে জ্ঞান ও শিক্ষা মানুষকে মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা:-এর সাথে পরিচিত করে, পরকালীন জবাবদিহি সৃষ্টি করে এবং সৎ ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলে তাই প্রকৃত জ্ঞান ও শিক্ষা। ইসলামে ইহকাল থেকে পরকাল বিচ্ছিন্ন নয়। পরকালের কর্ষণক্ষেত্র ইহকাল। ইসলামী রীতিনীতি ও বিধি অনুসারে কর্মসম্পাদন করলে সব কর্মই ইবাদতে পরিণত হয়। জ্ঞান ব্যক্তির চেতনা ও বুদ্ধিকে শাণিত করে, মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত করে এবং চরিত্র পরিশীলিত করে। রাসূলুল্লাহ সা:-এর নির্দেশনা অনুযায়ী জ্ঞান (ইলম) অর্জন করা প্রত্যেক নর-নারীর জন্য ফরজ বা বাধ্যতামূলক। ইসলামী পরিভাষায় একে ইলমুল হাল তথা অবস্থার জ্ঞান বলে। অর্থাৎ মানুষ যখন যে অবস্থায় পতিত হয় ওই অবস্থার করণীয় জ্ঞানার্জনই তার ওপর ফরজ। যেমন মানুষ যখন মুসলমান হয় তখন তার ওপর আল্লাহর অস্তিত্ব, গুণাবলি, ক্ষমতা এবং যা ছাড়া ঈমান পরিশুদ্ধ হয় না, তা অর্জন করা ফরজ।
যেকোনো জাতির জন্য একটি মজবুত শিক্ষাব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়। জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হলে সে দেশের বিশ্বাস, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ সামনে রাখতে হবে। শিক্ষানীতি হতে হবে আদর্শভিত্তিক ও জাতীয় চেতনার পরিপূরক। আধ্যাত্মিক, মানবিক, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতিই শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য হওয়া উচিত। একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা প্রণীত হতে হবে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা-চেতনানির্ভর। প্রাচ্য বা প্রতীচ্যের অন্ধ অনুসরণ আমাদের আদর্শিক দীনতার অতলান্তে নিক্ষেপ করবে। জনগণের বোধ ও বিশ্বাসের সাথে সঙ্গতি নয় এমন কোনো শিক্ষানীতি বা পাঠক্রম গ্রহণযোগ্য হবে না। আধুনিক শিক্ষার বিভিন্ন স্তর হতে ধর্মীয় শিক্ষা তুলে দিলে এবং মাদরাসায় প্রচলিত ধর্মীয় শিক্ষা সঙ্কুচিত হলে মানুষ ধর্মবিমুখ, জীবনবিমুখ ও সমাজবিমুখ হয়ে পড়বে। আমাদের শিক্ষানীতি হতে হবে অবশ্য ধর্মবিশ্বাস ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে। বিজ্ঞান শিক্ষা ও ধর্মশিক্ষা আলাদা নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা একটি প্রহসন মাত্র। আদর্শ ও চরিত্রবান মানুষ সৃষ্টির মাধ্যমে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় জাতির আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম প্রধান দেশ। এ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ধর্মপরায়ণ ও অসাম্প্রদায়িক। শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ধর্মশিক্ষার বিদায় অথবা ধর্মশিক্ষা সঙ্কোচন জনগণ সহজে মেনে নেবে না। ধর্মবিবর্জিত ও নাস্তিক্যবাদী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগ দেশ ও জাতির জন্য সমূহ বিপর্যয় ও অকল্যাণ বয়ে আনবে। এ রকম শিক্ষা ধারা হবে বাংলাদেশের জন্য অভিশাপ।
ব্রিটিশ যুগে লর্ড মেকলে (১৮০০-১৮৫৯) ভারত উপমহাদেশে সেক্যুলার যে শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন তার ধারাবাহিকতা আংশিক সংশোধন সাপেক্ষে বাংলাদেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আজো চালু রয়েছে। লর্ড মেকলের পরিকল্পনা ছিল সুদূরপ্রসারী। ১৮৩৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারতীয় শিক্ষার উপর ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন,
‘I have travelled across the length and breadth of India and I have not seen one person who is a beggar, who is a thief. Such wealth I have seen in this country, such high moral values, people of such calibre, that I do not think we would ever conquer this country, unless we break the very backbone of this nation, which is her spiritual and cultural heritage, and, therefore, I propose that we replace her old and ancient education system, her culture, for if the Indians think that all that is foreign and English is good and greater than their own, they will lose their self-esteem, their native self-culture and they will become what we want them, a truly dominated nation.’
অর্থাৎ ‘আমি ভারতের এ প্রান্ত হতে ও প্রান্ত পরিভ্রমণ করেছি এবং একজনকেও ভিক্ষা করতে দেখিনি; একজন চোরকেও পাইনি। এমন সম্পদ, এমন উন্নত নৈতিক মূল্যবোধ, এমন মেধাসম্পন্ন জনগোষ্ঠী আমি দেখেছি, যাদের জয় করতে পারব বলে আমার মনে হয়নি। হ্যাঁ, যদি তাদের শিক্ষার মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে পারি তাহলে সম্ভব। তাদের শিক্ষার ভিত্তি হলো আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যধারা। অতএব আমি তাদের পুরনো ও প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্থলে নতুন শিক্ষা ও সংস্কৃতি প্রতিস্থাপনের প্রস্তাব করি। এতে ভারতীয়রা মনে করবে ইংরেজ ও ইংরেজি ভাষা ও সংস্কৃতি নিজেদের শিক্ষা ও ঐতিহ্যের তুলনায় অধিকতর উন্নত ও সমৃদ্ধ। ফলে তারা আত্মমর্যাদা ও নিজেদের দেশজ সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলতে বাধ্য হবে এবং সত্যিকার অর্থে আমাদের শাসিত জাতিতে পরিণত হবে; মূলত আমরা যা চাই। (sundayposts, January 28, 2008; http://sundayposts.blogspot.com/2008/01/lord-macaulays-quote-on-india.html#.U1IbvaKZvfs)

ঈমান, আকিদা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধর্মীয় কৃষ্টি ও যুগচাহিদার প্রেক্ষাপট সামনে রেখে স্বাধীন বাংলাদেশের উপযোগী কোনো জাতীয় শিক্ষানীতি এ পর্যন্ত ঘোষিত ও প্রবর্তিত হয়নি। শিক্ষাব্যবস্থা চলছে অনেকটা জোড়াতালি দিয়ে ঔপনিবেশিক ধারায়। ফলে চরিত্রবান, আদর্শিক, খোদাভীরু নাগরিক সৃষ্টিতে এ শিক্ষাব্যবস্থা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। প্রাপ্তি যে একেবারে নেই এটি বলা যাবে না তবে প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির ফারাক দুস্তর। বেদনার সাথে বলতে হয়- বাংলাদেশের বেশির ভাগ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সন্ত্রাসী, দুর্বৃত্ত, আর্মড ক্যাডার ও ধর্ষকদের অভয়রাণ্য। উপরন্তু ছাত্র-রাজনীতির অসুস্থ চর্চা আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতোই অসহনীয়। রাজনীতিকরা ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থে নিরীহ ছাত্রছাত্রীদের দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশকে করেছেন কলুষিত অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারতে ছাত্র-রাজনীতি নিষিদ্ধ। আমাদের দেশে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষা ও আদর্শের দীক্ষা নেই; নেই আমাদের সমাজ ও সাংস্কৃৃতিক বোধের কোনো সম্পর্ক। ফলে চিন্তার বিভ্রান্তি, দুর্বৃত্তপনা, হানাহানি, শিক্ষাবিপর্যয় ও ধর্ষণ আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থাকে কলঙ্কিত করেছে। এখানে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে অস্ত্রবাজ, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, ভর্তিবাণিজ্যবাজরা সক্রিয় থাকে, মাঝে মধ্যে তাদের মধ্যে দখলদারিত্ব নিয়ে বন্দুকযুদ্ধ হয়- যেখানে নামধারী ‘ছাত্র’, অস্ত্রধারী যুবকরা অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে ‘যুদ্ধে’ লিপ্ত হয়, জীবন সংহার করে। ফলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার চত্বর পরিণত হয় রক্তাক্ত রণাঙ্গনে। উচ্চতর শিক্ষার উদ্দেশ্যে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে গমনকারী শিক্ষাজীবনের মাঝপথে লাশ হয়ে ঘরে ফেরে। ‘খুন কা বদলা খুন’ এর যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে তা এ দেশের ভবিষ্যৎকে নিশ্চিতভাবে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তুলবে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক ভারতীয় উপমহাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ইসলামী শিক্ষাই ছিল এ দেশের একটি জীবন্ত ও পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাব্যবস্থা। হিজরি প্রথম শতাব্দী থেকেই মালাবার উপকূল হয়ে পুরো ভারতবর্ষে মসজিদকেন্দ্রিক ইসলামী শিক্ষা চালু হয় সুফি, দরবেশ ও মুবাল্লিগদের মাধ্যমে। ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দে নাসিরউদ্দীন কুবাচা কর্তৃক মুলতানে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রথম মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পর থেকে চারদিকে ইসলামী শিক্ষা ছড়িয়ে পড়ে। ইংরেজ শাসন-শোষণ চিরস্থায়ী করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশরা ইসলামী শিক্ষাকে সমূলে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে লর্ড মেকলের মাধ্যমে সেক্যুলার শিক্ষা প্রবর্তন করেন। ব্রিটিশ রাজশক্তির অনুগত বাহিনী সৃষ্টির লক্ষ্যে ইংরেজি স্কুল ও কলেজ গড়ে তোলা হয় সর্বত্র। নানা সংস্কার, আইন ও বিধি প্রণয়নের বেড়াজালে আটকা পড়ে মাদরাসা তথা ইসলামী শিক্ষা অনেকটা অস্তিত্বহীন হয়ে দাঁড়ায়। শত বাধা ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও এ দেশের সংগ্রামী ওলামা-মাশায়েখ নিজেদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, মেধা ও শ্রমের মাধ্যমে মাদরাসা শিক্ষাকে টিকিয়ে রেখেছেন।

`

নেতৃত্বের সংস্কৃতি


আধুনিক শব্দটির বহুল ব্যবহার দেখছি। কথায় কথায় উচ্চারিত হয়। পোশাকে আশাকে আধুনিক, চলায় বলায়, ঘোরা ফেরায় আধুনিক। চার দিকে আধুনিকের ছড়াছড়ি! হ্যাঁ, আধুনিক উচ্চারিত হতেই থাকবে। এটিই সত্যি। কারণ আধুনিক মানেই তো সমসাময়িক। আধুনিক মানে যুগোপযোগী। আধুনিক মানে চলনসই এবং আধুনিক মানে যুগের প্রতিনিধিত্ব। জগতের বুকে যিনি যে সময়ে বিচরণ করেন, সে সময়টিতে তিনি আধুনিক। আমরা আমাদের সময়ে আধুনিক। তুলনায় গতকাল তার আগের দিনের চেয়ে আধুনিক। যেমন আজ গতকালের তুলনায়। যুগযুগান্তর পেরিয়ে মানুষ বর্তমানকে অতি আধুনিকতার চাকায় ঘোরাতে চায়। হয়তো ঘোরাচ্ছেও। হয়তোইবা বলি কেন- ঘোরাচ্ছেই নিয়ত।
কিন্তু সত্যি কি মানুষ আধুনিক! মানুষ কি পারে হিংসার দাগ মুছে সাদা মনের হতে? পারে কি বিদ্বেষের কালিমামুক্ত হয়ে স্বচ্ছ হতে; পারে কি লোভ-হীনতার আনন্দে জাগ্রত হতে? কই তেমন মানুষ! কই তেমন নেতৃত্ব! মানুষ তো স্বার্থের জালে বন্দী! পছন্দের বিষয়ে ন্যায়-অন্যায় মানে না। পদ-পদবির তৃষ্ণায় বিসর্জন দেয় নীতি! নিজের খায়েশ মেটাতেই ভীষণ কাতর! অন্যের অধিকার লুট করার কৌশলে ধুরন্ধর! এতসব বদ-গুণ অঙ্গে জড়িয়ে মানুষ কী করে আধুনিক! কী করে আধুনিকতার দাবি পরিণত হবে সত্যে! নিজ স্বার্থের জন্য অন্যকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে যারা দ্বিধাহীন! তারা আধুনিক নয়! তারা পাশবিক!
এসব বদ-গুণে গুণান্বিত ব্যক্তি আধুনিক নেতা নন। আধুনিক দায়িত্বশীলও নন। বদ-গুণের প্রকাশ্য-রূপ বর্বরতা। প্রতিহিংসার আগুন জ্বালানো হিংস্রতা। প্রতিশোধ নেবার মানসিকতা পাশবিক। এমনদের আধুনিক বলা যায় না। এমন নেতা বা দায়িত্ববান ব্যক্তি কখনো আধুনিক হতে পারে না।

প্রশ্ন হতে পারে, নেতৃত্বের আবার সংস্কৃতি কী? হ্যাঁ, এমন প্রশ্ন তুলতেই পারেন কেউ কেউ। আধুনিক নেতৃত্বের বিশেষ কিছু কৌশল আছে যা শুধু গুণ নয়, গুণের ঊর্ধ্বের কিছু। যা যোগ্যতা ছাপিয়ে ওঠে। এসব বৈশিষ্ট্য অর্জনের মাধ্যম জাগতিক নয়, আধ্যাত্মিক। সাধারণ নয় এটি অসাধারণ চৈতন্য। একজন নেতার অনেক গুণ থাকে। কিন্তু নেতৃত্বের সংস্কৃতি এসব গুণ ও যোগ্যতার উপরই হয়ে থাকে। তো কী সেই আধুনিক নেতৃত্বের সংস্কৃতি! কেমন হবে তার রঙ, কেমন তার রূপ! কোন কোন গুণের সাথে জড়িয়ে আছে আধুনিক নেতৃত্বের সংস্কৃতি!
আধুনিক নেতৃত্বের প্রথম সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য হলো, কোমল হৃদয়ের হবেন তিনি। হবেন হৃদয়বান মানুষ। অধীনস্থদের দিকে তার দৃষ্টি হবে দয়াদ্রতায় সিক্ত। কর্মীর প্রতি তিনি হবেন মানবিক! যুক্তির চেয়ে বেশি হবে হৃদয়ের টান। কঠোর আচরণ থেকে দূরে থাকবেন তিনি। হতে পারে তার অপছন্দের বিষয়! তবুও তিনি শীতল থাকবেন। সামান্যতেই তেজ দেখানোর বারুদ নিভিয়ে রাখবেন। কথায় কথায় ক্ষমতার তরবারি উত্তোলন করবেন না। মেজাজ দেখাবেন না। শ্রদ্ধার জায়গাটিতে তিনি হবেন আকর্ষণীয়।
দুই. পরামর্শের সৌন্দর্য গ্রহণ করবেন তিনি। একাই একশ’র ভাব ঝেড়ে ফেলবেন। একক সিদ্ধান্ত নিতে লজ্জাবোধ করবেন। একগুঁয়ে স্বভাব থেকে দূরে থাকবেন। যেকোনো বিষয়ে যোগ্য ব্যক্তির পরামর্শ গ্রহণ কর্তব্য মনে করবেন। একটি মাথা থেকে একাধিক মাথা উত্তম- এ বিশ্বাস দৃঢ় থাকবে তার। পরামর্শের কাজে পরাজিত হলে সেটিও সম্মানের। পরামর্শ গ্রহণ করা বনেদি বিষয়। উন্নত বংশের মানুষমাত্রই অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এমন ব্যক্তিরাই পরামর্শের সৌরভে মুখরিত হয়।
তিন. সাহসের সমাচার। কাপুরুষ ভীরু। সুপুরুষ সাহসী। কাপুরুষ কখনো সত্য স্বীকার করার সাহস রাখে না। সুপুরুষ সত্য ছাড়া আর কিছু গ্রহণও করেন না। মিথ্যার দুর্গন্ধ-জলে ডুবন্ত প্রায় কাপুরুষ। সত্যের ঝরনায় সাঁতার কাটে সুপুরুষ। পরামর্শের পর সিদ্ধান্তে দৃঢ় থাকবেন তিনি। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সাহসী হবেন খুব। ভীরুতার অকল্যাণ থেকে দূরে থাকবেন। অযৌক্তিক আচরণের মুখে থাকবেন অবিচল। সব সঙ্ঘাতে হবেন সাহসী। ভীরুতা মানুষকে অপরাধ করতে সাহায্য করে। নিজের পদ হারানোর ভয় থাকে তার। তখন অযোগ্যতার সাথে সন্ধি করে সে। লিপ্ত হয় গোপন ষড়যন্ত্রে। সৎ এবং যোগ্যরা এদের বড় শত্রু হয়ে যায়।
চার. ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বের দৃষ্টি। হ্যাঁ, ঠিক তাই। তার দৃষ্টি হবে দিগন্তবিশারী। পায়ের পাতায় থাকবে না তার চোখ। তিনি হবেন স্বর্ণ ঈগলের দৃষ্টিধারী। তিনি কখনো একচক্ষু হবেন না। ন্যায়ের বিষয়ে হবেন একপায়ে খাড়া। নীতিহীনতার অসুন্দর তাকে কলুষিত করবে না। তার চোখের ভাষা মায়াবী। উদারী মনের ভাষা। মুখের ভাষা মধুময়।

পাঁচ. বন্ধুত্বের আবহ। আধুনিক নেতৃত্বের এটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কৃতি। সহকর্মীদের সাথে থাকবে বন্ধুত্বের আবহ। আচরণ হবে বন্ধুসুলভ! হামবড়া ভাব থেকে মুক্ত তিনি। সব বুঝির গাধামি পেয়ে বসবে না তাকে। ঔদ্ধত্য থাকবে না তার। গোঁড়ামির সঙ্কীর্ণতা ঝেড়ে ফেলেন তিনি। অকারণ অহঙ্কারী নন। সব কাজের কাজী হন না কখনো। ব্যক্তিগত আক্রমণের মানসিকতা মুক্ত। কর্মীদের প্রতি সম্মানজনক দৃষ্টি থাকে তার। অন্যের কথার প্রতি থাকে সম্মান। ছোট বড় সবার মতামতের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল। সবাইকে নিয়ে চলার আনন্দ উদযাপন করেন তিনি। তিনি কথা ও কাজে হবেন অকপট।
ছয়. নৈতিক নিরাপত্তা। আধুনিক নেতৃত্ব নৈতিক নিরাপত্তায় অগ্রগামী হবেন। কর্মীরা নির্বিঘেœ মিশবে তার সাথে। খুলে বলবে মনের কথা। সবার কথা আমানত থাকবে তার কাছে। তিনি গ্রুপিং করবেন না। কোনো কোন্দলে পক্ষ নেবেন না। তার লক্ষ্য হবে প্রতিষ্ঠান কিংবা সংগঠনের চূড়ান্ত স্বার্থ। কর্মীরা সব দিক থেকে বোধ করবে নিরাপদ। এটিই নৈতিক নিরাপত্তা। লোক দেখানো নয়, একদম আন্তরিক। একদম সততার নিরিখে। তার ভূমিকা হবে সন্দেহের ঊর্ধ্বে। কার্যক্রম হবে স্বচ্ছতায় উদ্ভাসিত। তিনি সত্য লুকাবেন না। আশ্রয় নেবেন না মিথ্যার। তিনি সবচেয়ে বেশি সম্মান করবেন নিজেকে। অন্যের প্রতি যথার্থ ইনসাফ করাই হলো নিজেকে সম্মানিত করা। অন্যের অধিকার বুঝিয়ে দেয়াই নিজের প্রতি সম্মান দেখানো। ঔদ্ধত্য অহঙ্কারী নিজেকেই নিজে সব থেকে বেশি অপমান করে।
সাত. সমালোচনার ভার বহন। পদে থাকা মানেই সমালোচনা হবেই। দায়িত্বে থাকলেই বইবে সমালোচনার ঝড়। যৌক্তিক সমালোচনা গ্রহণ করাই হলো আধুনিক নেতৃত্বের সংস্কৃতি। এমনকি অযৌক্তিক সমালোচনাও মুখ বুজে হজম করতে হবে। ঢোক গিলে ফেলতে হবে সহসা। কম কিংবা বেশি সমালোচনা হবে। মানুষের মুখ সেলাই করে রাখা যায় কি। নাকি চেপে ধরা যায়! না, কোনোটিই করা যায় না। তবে? সমালোচনার ভারটুকু গ্রহণ করার মানসিকতা থাকতে হবে।
আট. উৎসবমুখরতা। কাজের প্রাণ হলো উৎসবমুখরতা। নেতৃত্বের মুখ হবে প্রেরণাদায়ক মুখ! হাসি হবে প্রেরণার হাসি। দৃষ্টি হবে ঔজ্জ্বল্যের উপমা। কেউ কাছাকাছি হলে সুখ অনুভব করবে। যত কাছে আসবে ভালো লাগবে ততই। কথা বললে উৎসাহিত হবে। কাজ করলে উৎসাহিত হবে। মতবিনিময় করলে পাবে নতুন জীবনের ইঙ্গিত। সবাই সান্নিধ্য কামনা করবে তার। উপস্থিত অনুপস্থিত দুই ক্ষেত্রেই তার কল্যাণ কামনা করবে সবাই। তিনিও কল্যাণ কামনা করবেন সবার। একই সাথে কর্মীদের গুণ বিচার করবেন তিনি। পক্ষপাতকে মনে করবেন অপরাধ। সব পরিস্থিতিতে তিনি মনোবল চাঙ্গা রাখবেন সহকর্মীদের।

নয়. খোশ মেজাজের দ্যুতি থাকবে তার। অন্যের বাঁকা কথায়ও হাস্যোজ্জ্বল থাকবেন তিনি। কপাল কুঁচকাবেন না সহসা। অস্থির হবেন না সহজে। অসহিষ্ণুতা দেখাবেন না। দায়িত্ব এড়িয়ে যাবেন না। খণ্ডিত নন তিনি। সামগ্রিকতায় উদ্ভাসিত হবেন। সবাই ভাববে তিনিই তার কাছের। তিনি অধৈর্য নন। অসংযমী নন। কথা ও কাজে পরিপূর্ণ হবেন। হাসিমুখে সাক্ষাৎ হবে তার। দুঃখী মনগুলো খোশ হয়ে উঠবে তার সান্নিধ্যে। অন্যের সম্মান নিরাপদ হবে তার কাছে। কারো ইজ্জত হরণ করার ইচ্ছে থাকবে না তার। খোলা মন খোলা হাসি- সবাইকে ভালোবাসি- হবেন তিনি। তার কাছে সবার থাকবে ইনসাফের নিরাপত্তা।
দশ. স্বীকৃতির ঔদার্য। স্বীকৃতির ঔদার্যে উজ্জ্বল হবেন তিনি। ছোট বড় কাজে সাফল্যের স্বীকৃতি দেবেন তিনি। ভালো কাজের প্রশংসায় কৃপণ হবেন না। মন খুলে স্বীকৃতি দেবেন। কথায় স্বীকার করবেন। কাজেও থাকবে স্বীকৃতি। স্বচ্ছতার সৌরভে মুখরিত হবেন রোজ। অন্তর বাজিয়ে তুলবেন তিনি। স্বীকৃতির সৌন্দর্য আধুনিক নেতৃত্বের জরুরি সংস্কৃতি। স্বীকৃতির চূড়ান্ত রূপ সাফল্যের পুরস্কার দান। তিনি আনন্দের সাথে সাফল্যের পুরস্কার দেবেন। কারণ পুরস্কার হলো বড় স্বীকৃতি। আর স্বীকৃতি একজন কর্মীকে এগিয়ে দেয় বহুদূর।
আধুনিক নেতৃত্বের সংস্কৃতি উন্নত সংস্কৃতি। একজন নেতা বা দায়িত্ববান ব্যক্তিকে এসব সংস্কৃতির যথার্থ লালন করতে হয়। চর্চা করতে হয়। বাস্তবতায় সত্য করে তুলতে হয়। সহজাত করে নিতে হয় নিজেকে। পরিণত করে নিতে হয় অভ্যাসে। বাইরে থেকে নয় উজ্জ্বল হতে হয় ভেতর থেকে। সাময়িক নয়, হতে হয় সব সময়ের। লোকদেখানো নয়, তিনি হবেন নিজস্ব ভুবনের কারিগর। এসব সংস্কৃতির রঙ নেতৃত্বের সামগ্রিকতায় উদ্ভাসিত হলে সাফল্য তার কাছে নিজে থেকেই আসে।

সৃজনশীল ক্রমবিকাশের মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অপূর্ণ সৃষ্টিকে রূপান্তরের ধারাবহিকতায় পূর্ণতা দান করেন। নিম্নলিখিত আয়াতগুলোর মাধ্যমে একটি বিষয় পরিষ্কার বোঝা যায়, আল্লাহর সৃষ্টিকৌশল ও সৃজনশীল ক্রমবিকাশের মাধ্যমে সংঘটিত বস্তুজগতের ধারাবাহিক রূপান্তরের উদ্দেশ্য মূলত চারটি-
১. আল্লাহর নিদর্শন হিসেবে সৃষ্টিজগতের বৈচিত্র্য ও ধারাবাহিকতা রক্ষা করা।
২. ক্রমবিবর্তনকে বিশ্বজগতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আল্লাহর ন্যায় প্রতিষ্ঠার প্রধান কৌশল হিসেবে তুলে ধরা।
৩. সৃষ্টিজগতের অপূর্ণতাকে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে নেয়া।
৪. মানব প্রকৃতির (ফিতরা) সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ক্রমোন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা।
সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলো : ‘নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সব কিছু ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করিনি। আমি এগুলো যথাযথ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছি; কিন্তু তাদের অধিকাংশই বোঝে না।’ (সূরা, ৪৪ : ৩৮-৩৯)
যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশ মণ্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা করে ও বলে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি এটি নিরর্থক সৃষ্টি করোনি, তুমি পবিত্র, তুমি আমাদেরকে দোজখের শাস্তি থেকে রক্ষা করো।’ (সূরা, ৩ : ১৯১-১৯২)
মূলত প্রতিটি মানুষ যে আনুগত্যের দিকে ফিরে আসতে চায়, (এর প্রতিটি জিনিসই) তার চোখ খুলে দেবে এবং তাকে (আল্লাহর অস্তিত্বের) পাঠ মনে করিয়ে দেবে।’ (সূরা, ৫০ : ৮)

ক্রমবিকাশ


শীল ক্রমবিকাশের মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অপূর্ণ সৃষ্টিকে রূপান্তরের ধারাবহিকতায় পূর্ণতা দান করেন। নিম্নলিখিত আয়াতগুলোর মাধ্যমে একটি বিষয় পরিষ্কার বোঝা যায়, আল্লাহর সৃষ্টিকৌশল ও সৃজনশীল ক্রমবিকাশের মাধ্যমে সংঘটিত বস্তুজগতের ধারাবাহিক রূপান্তরের উদ্দেশ্য মূলত চারটি-
১. আল্লাহর নিদর্শন হিসেবে সৃষ্টিজগতের বৈচিত্র্য ও ধারাবাহিকতা রক্ষা করা।
২. ক্রমবিবর্তনকে বিশ্বজগতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আল্লাহর ন্যায় প্রতিষ্ঠার প্রধান কৌশল হিসেবে তুলে ধরা।
৩. সৃষ্টিজগতের অপূর্ণতাকে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে নেয়া।
৪. মানব প্রকৃতির (ফিতরা) সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ক্রমোন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখা।
সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলো : ‘নভোমণ্ডল, ভূমণ্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সব কিছু ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করিনি। আমি এগুলো যথাযথ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছি; কিন্তু তাদের অধিকাংশই বোঝে না।’ (সূরা, ৪৪ : ৩৮-৩৯)
যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশ মণ্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা করে ও বলে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি এটি নিরর্থক সৃষ্টি করোনি, তুমি পবিত্র, তুমি আমাদেরকে দোজখের শাস্তি থেকে রক্ষা করো।’ (সূরা, ৩ : ১৯১-১৯২)
মূলত প্রতিটি মানুষ যে আনুগত্যের দিকে ফিরে আসতে চায়, (এর প্রতিটি জিনিসই) তার চোখ খুলে দেবে এবং তাকে (আল্লাহর অস্তিত্বের) পাঠ মনে করিয়ে দেবে।’ (সূরা, ৫০ : ৮)

যারা (নিশ্চিতভাবে) বিশ্বাস করত বিশ্বাসকারীদের জন্য পৃথিবীতে নিদর্শনাবলি রয়েছে এবং তোমাদের নিজেদের (এ দেহের) মধ্যেও, তোমরা কি অনুধাবন করবে না? আকাশে রয়েছে তোমাদের রিজিক ও প্রতিশ্রুত সব কিছু।’ (সূরা, ৫১ : ২০-২২)
উপরোক্ত আয়াতগুলোর মাধ্যমে আল-কুরআন আল্লাহর বিশ্ব সৃষ্টির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা ব্যক্ত করেছে। আর আল্লাহর মনোনীত খলিফা হিসেবে সেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সাধনের দায় মানুষের ওপর বর্তেছে। আল্লাহর সৃজনশীল ক্রমবিকাশ সেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সাধনের উপযোগী করে মানুষকে গড়ে তোলে।
বিশ্ব-প্রকৃতিতে আল্লাহর ক্রমবিকাশের প্রধান দু’টি হাতিয়ার হলো-
১. মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যকার বিপর্যস্ত ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠাকারী প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো যথা- ঘূর্ণিঝড়, খরা, প্লাবন, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, দাবানল, ভূমিকম্প, সুনামি ইত্যাদি।
২. রোগ, মহামারী, অতিমারী ও মানুষের দেহে জিনগত পরিবর্তন সৃষ্টিকারী ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস ও ছত্রাকজাতীয় অণুজীবগুলো।
আল্লাহ বলেন- ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন জলে-স্থলে (সর্বত্র আজ) বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে, (মূলত) আল্লাহ তাদের কতিপয় কাজকর্মের জন্য তাদের শাস্তির স্বাদ আস্বাদন করাতে চান, সম্ভবত তারা সে সব কাজ থেকে ফিরে আসবে।’ (সূরা, ৩০ : ৪১)
মানুষের কৃতকর্মের জন্য জল-স্থল, অন্তরীক্ষে অন্যায়-অবিচার ও মানুষের মৌলিক প্রকৃতি বিরোধী কর্মকাণ্ড বা পাপাচার ছড়িয়ে পড়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে কুরআনের আয়াত- ৬ : ৬, ৫৬ : ৬০-৬১, ৩৭০ : ৪০-৪১-এ বর্ণিত- বর্তমান মানবজাতির ধ্বংস ও নতুন জাতির উত্থানের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। যুদ্ধ-বিগ্রহ, ধ্বংস, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারী ও অতিমারীর ভয়াবহ ধ্বংসলীলা আল্লাহর সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

‘ঘবি ওফবধং রহ ঝপরবহপব’ গ্রন্থের লেখক বিজ্ঞানী রবার্ট ব্রুকসের মতে : রোগব্যাধি এখনো মানুষের ক্রমবিকাশের এক বড় চালিকাশক্তি। কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের বংশানুক্রমিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ম্যালেরিয়া, এইচআইভি প্রভৃতি রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বেশি। আবার অধিকাংশ মানুষেরই বংশধারা থেকে ঈধংঢ়ধংব-১২ নামে জিনটি হারিয়ে গেছে। এর সম্ভাব্য কারণ হলো, এই জেনেটিক বৈশিষ্ট্যধারী মানুষদের ব্যাক্টেরিয়াজাত রোগব্যাধির প্রতি অতি-সংবেদনশীলতা। এই পরিবর্তনের গতি ধীর হলেও আমরা যে পরিবর্তিত হচ্ছি এতে কোনো সন্দেহ নেই।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারী, অতিমারীসহ সব কিছুই আল্লাহর সামগ্রিক সৃষ্টিপরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিশ্বপ্রশাসন ও ক্রমবিবর্তনের হাতিয়ার। নিম্নলিখিত আয়াতগুলো থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, সৃষ্টিজগতের ধারাবাহিক রূপান্তর ও ক্রমবিবর্তন আল্লাহর সৃষ্টিকৌশলেরই অংশ। বস্তুজগতের নিরবচ্ছিন্ন ক্রমবিকাশের মধ্য দিয়েই আল্লাহ তাঁর সৃষ্টিশৈলীর প্রকাশ ঘটান।
‘তারা কি দেখেনি, তাদের আগে আমি এমন বহু জাতিকে বিনাশ করে দিয়েছি যাদের আমি পৃথিবীতে এমনভাবে প্রতিষ্ঠা দান করেছিলাম, যা তোমাদেরও করিনি। আকাশ থেকে তাদের ওপর প্রচুর বৃষ্টিবর্ষণ করেছি, আবার তাদের (মাটির) নিচ থেকে আমি ঝরনাধারা প্রবাহিত করে দিয়েছি, অতঃপর পাপের জন্য আমি তাদের (চিরতরে) ধ্বংস করে দিয়েছি, আর তাদের পর (তাদের জায়গায় আবার) এক নতুন জাতির উত্থান ঘটিয়েছি।’ (সূরা, ৬ : ৬)
আল্লাহর নির্দেশে এ (ঝড়) সব কিছুই ধ্বংস করে দেবে, তারপর তাদের অবস্থা (সত্যিই) এমন হলো যে, তাদের বসতবাড়ি ও তার ধ্বংসলীলা ব্যতীত আর কিছুই দেখা গেল না, আমি এভাবেই অপরাধী জাতিগুলোকে (তাদের কৃতকর্মের) প্রতিফল দিয়ে থাকি।’ (সূরা, ৪৬ : ২৫)
‘তোমাদের মধ্যে সবার মৃত্যু আমিই নির্ধারণ করি এবং আমি এ ব্যাপারে মোটেই অক্ষম নই যে, তোমাদের মতোই আরেক দল মানুষ দিয়ে তোমাদের বদল করে দেবো এবং (প্রয়োজনে) তোমাদেরই (আবার) এমনভাবে তৈরি করব তোমরা কিছুই জানতে পারবে না।’ (সূরা, ৫৬ : ৬০-৬১)
উপরোক্ত আয়াতগুলো থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, কুরআনের দৃষ্টিতে ক্রমবিকাশ আল্লাহর ন্যায় প্রতিষ্ঠার একটি শক্তিশালী মাধ্যম। আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রোগব্যাধি, মহামারী, অতিমারীসহ সব কিছুই ক্রমবিকাশের শক্তিশালী হাতিয়ার।

Leave a Reply